ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায়: একটি সুষম দৃষ্টিভঙ্গি
ডায়াবেটিস বা মধুমেহ একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ, যা বিশ্বের বহু মানুষকে প্রভাবিত করে। এই রোগের ফলে শরীরে শর্করার মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যায়, যা হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা, দৃষ্টিহীনতা, এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করতে পারে। তবে প্রশ্নটি হল, ডায়াবেটিস কতটা গুরুতর হলে এটি মৃত্যুর কারণ হতে পারে? আসলে, ডায়াবেটিস নিজে সরাসরি মৃত্যুর কারণ নয়, তবে এটি অন্যান্য জটিল রোগ সৃষ্টি করতে পারে, যা যদি নিয়ন্ত্রণে না রাখা হয়, তাহলে মৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এই আর্টিকেলে, আমরা ডায়াবেটিসের গুরুতর প্রভাব এবং তার সাথে সম্পর্কিত ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করব।
১. টাইপ ১ ও টাইপ ২ ডায়াবেটিসের মধ্যে পার্থক্য
ডায়াবেটিসের দুটি প্রধান ধরনের মধ্যে টাইপ ১ এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস রয়েছে।
টাইপ ১ ডায়াবেটিস: এই ধরনের ডায়াবেটিস সাধারণত শিশু বা তরুণদের মধ্যে দেখা যায় এবং এটি একটি অটোইমিউন রোগ, যেখানে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলোকে ধ্বংস করে। টাইপ ১ ডায়াবেটিসের রোগীদের ইনসুলিন গ্রহণ করতে হয় এবং এটি যত্নসহকারে নিয়ন্ত্রণে না রাখলে জীবনযাত্রার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
টাইপ ২ ডায়াবেটিস: এটি সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে দেখা যায় এবং জীবনযাত্রার কারণে (খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক অক্রিয়তা, অতিরিক্ত ওজন) বেশি হয়। টাইপ ২ ডায়াবেটিসে ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমে যায়, যা রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এই ধরনের ডায়াবেটিস বেশি অবহেলা করলে হৃদরোগ, কিডনি সমস্যার মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে।
২. ডায়াবেটিসের জটিলতা এবং মৃত্যুর ঝুঁকি
ডায়াবেটিসের সঠিক চিকিৎসা না হলে এটি বিভিন্ন গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়, তবে এটি সরাসরি মৃত্যুর কারণ নয়। ডায়াবেটিসের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি হতে পারে, যার মধ্যে কিছু প্রাণঘাতী পরিণতি হতে পারে।
১. হৃদরোগ
ডায়াবেটিস দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, এবং ইনসুলিন প্রতিরোধের কারণে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক ঝুঁকি হতে পারে।
২. কিডনি ব্যর্থতা
ডায়াবেটিসের কারণে কিডনির কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যেতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত কিডনি ব্যর্থতায় রূপ নিতে পারে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা যখন কিডনি ব্যর্থতা পায়, তখন ডায়ালিসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হতে পারে। তবে, যদি এটি ঠিকভাবে চিকিৎসা না করা হয়, তবে কিডনি ব্যর্থতা মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
৩. দৃষ্টিহীনতা (রেটিনোপ্যাথি)
ডায়াবেটিস চোখের নেটওয়ার্কের ক্ষতি করতে পারে, যার ফলে দৃষ্টিহীনতা হতে পারে। যদি রেটিনোপ্যাথি খুব বেশি বেড়ে যায়, তবে এটি পুরোপুরি দৃষ্টি হারানোর কারণ হতে পারে।
৪. অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অঙ্গহানি
ডায়াবেটিসের কারণে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, বিশেষ করে পা এবং হাতের নীচের অংশে। এর ফলে ক্ষত সেরে ওঠা দেরি হয় এবং সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। এক্ষেত্রে, সংক্রমণ অত্যন্ত গুরুতর হতে পারে এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাটার প্রয়োজন হতে পারে।
৫. ব্লাড সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণ না থাকলে:
ডায়াবেটিক কেটোসিডোসিস (DKA) এবং হাইপারসমোলার কোমা
ডায়াবেটিসের কারণে যদি রক্তে শর্করার পরিমাণ অতিরিক্ত বেড়ে যায়, তবে ডায়াবেটিক কেটোসিডোসিস (DKA) বা হাইপারসমোলার কোমার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এই অবস্থায় শরীর অত্যন্ত ডিহাইড্রেটেড হয়ে যায়, শ্বাসকষ্ট শুরু হয় এবং যদি দ্রুত চিকিৎসা না করা হয়, তবে এটি মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
৩. ডায়াবেটিসের মৃত্যুর ঝুঁকি কমানোর উপায়
যদিও ডায়াবেটিস সরাসরি মৃত্যুর কারণ নয়, তবে এর সঙ্গে সম্পর্কিত জটিলতা ও ঝুঁকি জীবননাশক হতে পারে। তবে, সঠিক জীবনযাপন এবং চিকিৎসার মাধ্যমে এই ঝুঁকিগুলো কমানো সম্ভব। কিছু উপায় যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করতে পারে:
নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম: শারীরিক কার্যকলাপ ইনসুলিন প্রতিরোধ কমাতে এবং রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
সঠিক খাদ্যাভ্যাস: স্বাস্থ্যকর খাবারের মাধ্যমে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। সাদা চিনি এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করা উচিত।
ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন ডায়াবেটিসের লক্ষণ বৃদ্ধি করতে পারে, তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
মেডিকেশন ও ইনসুলিন: ডাক্তারের পরামর্শে সঠিক ডায়াবেটিসের ঔষধ গ্রহণ করা এবং ইনসুলিন গ্রহণ প্রয়োজন হতে পারে।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং রক্তের শর্করা পরিমাপ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার
ডায়াবেটিস একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ, কিন্তু যদি এটি অবহেলা করা হয়, তবে এটি গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সঠিক খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক কার্যকলাপ এবং নিয়মিত চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তারের পরামর্শ নিলে ডায়াবেটিসের জটিলতা এবং মৃত্যুর ঝুঁকি কমানো সম্ভব।